জীবনবাবু মাঝরাতে বাথরুমে উঠলেন । কাল বিশ্বাসঘাতকতার আবহাওয়ায় খিচুড়ি খেয়ে ফেলেছিলেন । অনেকক্ষণ ধরে মেঘ জমে জমে সন্ধ্যেবেলায় বেশ দুটান হাওয়া ছাড়লো । বেশ মিষ্টি , ঠান্ডা , ভেজা ভেজা হাওয়া । কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে এই খবর দেওয়া হওয়াটির ভরসায় নিশ্চিন্তে খিচুড়ি চাপিয়ে ফেললেন জীবনবাবু । আসলে চাপালেন না , গিন্নিকে মোলায়েম হুকুম করলেন মাত্র । গিন্নির খিচুড়ি তোফা । শুধু একটু ঘি পড়লে সাথে কিছু লাগেনা । সেই বৃষ্টি ঢুঁ ঢুঁ । একবার ঢুঁ মারবার প্রয়োজনও মনে করল না । আর ‘বঙ্গে শিল্প নেই ইলেকট্রিক আছে’ এ স্লোগানও ক্ষণে ক্ষণে মিথ্যে হতে লাগলো । জীবনবাবু আকাশের মতোই গুম মেরে গেলেন । রাত সোয়া দশটা নাগাদ খেয়ে , এগারোটায় শুয়ে , সাড়ে বারোটায় যখন বাথরুমে উঠলেন তখনও ঠিকঠাক মাঝরাত হয়নি ।
খাটের ডানধারে তাঁর জায়গা । মেঘের গুমোটটা বেশ করেছে । মশারী তুলে নেমে পাশের ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলে দিলেন । বারান্দার সাথে ক্রস ভেন্টিলেশন হবে । উল্টো পায়ে বাথরুমে চললেন । খাবারঘর , ফ্রিজের বোর্ডের লাল আলো , বাইরে পি. ডাব্লিউ. ডি অফিসের সাদা আলো মিলিয়ে বেশ পরিস্কার পথ । ডানধারের দেয়াল হাতড়ে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করলেন জীবনবাবু । এই দু কামরার খোলামেলা ভাড়া বাড়িতে আসা ইস্তক সাড়ে চার বছরে খুব কম একবারে বাথরুমের আলোটা জ্বলেছে । আজ ফস্কালো । আধ ঘুমন্ত অবস্থায় এ এক জ্বালা । পরের সুইচটা মান না রাখলে জীবনবাবুর বিরক্তি আর জলত্যাগের বেগ দুইই বেড়ে উঠত । ডানধারের প্লাস্টিকের দরজা ঠেলে জীবনবাবু ঢুকলেন । নীল-সাদা অ্যালমুনিয়ামের মগ , লাল সিমেন্টের মেঝে , ঝকঝকে সাদা আলো । জীবনবাবু নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না । মেঝের মাঝামাঝি একটা আরশোলা । ক্ষুদ্র তবু তুচ্ছ নয় । এমন কিছু ক্ষুদ্রও নয় । বেশ চার আঙ্গুল লম্বা , বড় পেঁয়াজের গাঢ় লাল খোলার মত গায়ের রং , শুঁড়গুলো নড়ছে । থমকালেন জীবনবাবু । ভেবেছিলেন আধো ঘুমে কাজ সেরে পেট ভরে জল খেয়ে নিশ্চিন্তে আবার ঘুমের মধ্যে দিয়ে সেঁদিয়ে পড়বেন । নাহ । আরশোলাটা তাঁকে পুরো সচেতন করতে না পারলেও অনেকটা জাগিয়ে তুলল । জীবনবাবু ধৈর্য হারালেন না । এদের স্বভাব তিনি খুব জানেন । টিভির বিজ্ঞাপনের নায়িকা আরশোলা দেখে না খাবার আছিলা বানানোর অনেক আগে থেকে তিনি এদের সঙ্গে ঘর করছেন । বিশেষ গত সাড়ে চার বছরে অন্তত একশো আরশোলা জীবনবাবু মেরেছেন । খুব ছুটতে পারে এগুলো । ডানা মেলে ফরফর করে উড়ে যায় । আবার একটু দূরে গিয়েই থপ করে বসে পড়ে । পাখাগুলো শরীরের তুলনায় মজবুত নয় । আর মাঝে মাঝেই বেভভুলের মত করে ওড়ে । দিশদিশা থাকেনা । বাঁচবার চেষ্টায় ঘাতকের দিকেই উড়ে বা দৌড়ে আসে । তখন নড়েচড়ে , পা তুলে , মাথা বাঁচিয়ে বাথরুমের ওটুকু পরিসরে খুব ভয়ে থাকেন জীবনবাবু ।
চানের জায়গাটা পেরিয়ে পায়খানার প্যান একটু উঁচু করে বসানো । তার বাঁ ধারে কাঁধ সমান উঁচুতে একটা আধহাত কাচের রিভলভিং জানলা । তারই ওপর রাখা থাকে বাথরুম পরিষ্কারের লিকুইড । সেই লিকুইড ঢেলে আগে আগে খুব আরশোলা মারতেন মাঝরাতে । কিন্তু মহা ঝঞ্ঝাট । একফোঁটা গায়ে পড়তে না পড়তেই ছুটে আরশোলাগুলো লুকিয়ে পড়ত মগের পেছনে , বালতির কোনায় , বাথরুম ঘষা ব্রাশের পেছনে । বুঝত না আড়াল চিরকালের নয় । কখনো কখনো তো দরজার কব্জার কাছে গিয়ে লুকিয়েছে । নিজেরাই কব্জা হয়ে গেছে । যখনই দরজা পুরো পাল্লা ঠেসে বন্ধ হতো আর করাত-মচাত , পুরো চটকে গেল আরশোলা । জীবনবাবু এসব নির্বুদ্ধিতায় মৃদু ব্যঙ্গের দার্শনিক আনন্দ পেয়েছেন বহুবার । আর মগ তুলে , বালতি সরিয়ে , ঝাঁটা নাড়িয়ে জীবনবাবু বের করে আনতেন আরশোলা । আবার লিকুইড ঢালতেন । কিন্তু মরবার একটু ধৈর্য নেই আরশোলাগুলোর । খালি পালাত । দেওয়ালে উঠে যেত । টালি বসানো দেয়াল । হড়কাত । পড়ত । আবার উঠত । দেওয়াল আর মেঝের কোণ ধরে দুফুট ছুটে গিয়ে আবার উঠতে চেষ্টা করতো । ওদের মাথায় আসতো না যে দেওয়ালগুলো পুরোটাই পিছল । জীবনবাবুও লিকুইড ঢালতে ঢালতে ওদের পেছনে পেছনে ছুটতেন । তারপর এক জায়গায় মুখে মাথায় অনেকটা লিকুইড পেয়ে আরশোলা ছটফট করত আর কিচকিচ করে চ্যাঁচাত । জীবনবাবুর একটা অস্বস্তি হতো । কিন্তু আরশোলা না মারলে হবে ! সমস্যাটা হত আরশোলাটা মরে গেলে । জল ঢেলে মরা আরশোলা জল যাবার ফুটো দিয়ে ঢেইয়ে দেবার পর চোখে পড়তো লিকুইড ছাপ রেখে গেছে । মেঝেয় সাদা সাদা দাগ এসিডের মতো । পরে বাথরুমে ওই দাগগুলো দেখলে আরশোলা মারা রাতগুলো মনে পড়তো । আলাদা অস্বস্তি হতো না ।
বাথরুমের বাইরে ঝেঁটিয়ে জুতিয়ে আরশোলা মারতে হত জীবনবাবুকে । আর রান্নাঘরে বড় আরশোলা ছাড়াও ছোট ছোট ঐরম ডানাওলা পোকা যে কত ! বই দিয়ে পিটিয়ে মেরেছেন । হালকা কভারের ফ্লেক্সিবল পত্রিকাগুলো খুব কাজে এসেছে সে সময় । মেরে মেরে অনেক কমিয়ে ফেলেছেন কিন্তু শেষ হয়নি । তাঁকে দেখলেই এখন আরশোলা আর ডানাওলা পোকাগুলো লুকিয়ে পড়ে । এমনিতেই তারা খুব বুক ফুলিয়ে কারো সামনে যায় না । তাদের সম্ভবত বুকও নেই । কিন্তু জীবনবাবু ওত পেতে থাকেন । উড়ন্ত , পড়ন্ত , চলন্ত , ছুপন্ত কাউকে ছাড়েন না । এগুলো জায়গা নষ্ট করে । জীবনবাবু ও তাঁর পরিবারের খাবার নষ্ট করে । দেখলেই গায়ে একটা ঘিনঘিনে বিরক্তি আসে । তাই তিনি লিকুইড ছেড়ে স্প্রে ধরেছেন । লাল রঙের স্প্রে সিলিন্ডার । তার সরু মুখ দিয়ে , যেখানে দেখতে পান , সেখানেই ছিটিয়ে দেন । আবার ওই গন্ধটাও নাকে খুব ঠেকে । বেসাবধানে খাবার জায়গায় না চলে যায় । কিন্তু রান্নাঘরেই ওদের সংবৃত সংসার । ফুটো , ফাটল কোথায় না আছে ! সেখানে গিয়ে চুপ করে অপেক্ষা করে । অন্ধকার হলে অপেক্ষা করে । রান্না ঘরের দরজা বন্ধ হলে অপেক্ষা করে । রাত্রিবেলা রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে জীবনবাবু বুঝতে পারতেন আরশোলা হুটোপুটি করে উচ্ছিষ্ট খাচ্ছে । মাঝে মাঝে দরজা খুলে , আলো জ্বালিয়ে সেখানেও মেরেছেন । কিন্তু দেশি পদ্ধতিতে । ঝাঁটা । দুম-দাম-দুড়ুম-দাড়াম করে আরশোলা মারার সে অ্যাডভেঞ্চার এখন আর হয় না । পাশের ঘরেই জীবনবাবুর দু’বছরের ছেলে ঘুমোয়। উঠে পড়লে চিত্তির । এখন পরের দিন সকালে সরোদিকে বলেন ‘বাসনগুলো ভালো করে মেজো । রাত্তিরে আরশোলা খুব চেটেছে’ ।
আজকের আরশোলাটা নিজেও বোধহয় লাল মেঝেতে বসে ঘুমোচ্ছিল । ফট করে ফটফটে আলো হয়ে হয়ে যাওয়া বাথরুমের মাঝখানে খোলা বিপজ্জনক জায়গা ছেড়ে ঝট করে সরে যেতে পারল না । একটু নড়ে ডান দিকে মুখটা ফেরালো মাত্র । এটা বোধহয় নতুন দেশ থেকেই এসেছে । জীবনবাবুকে এক পলক দেখেও পালালো না ! একটু সরে গেল মাত্র । বেশ ভারী চেহারা , ফোড়ন দেওয়া শুকনো লঙ্কার মত রঙ , দুফুট দূরে সরে গিয়ে দাঁড়াল । জীবনবাবু নিশ্চিন্ত হলেন । এটা বেশি উড়তে পারবে না । ডান দিকে হাত বাড়িয়ে কোমর নামিয়ে তুলে নিলেন বাথরুম ঘষা ব্রাশটা । কী মুস্কিল ! ফরফর করে সেটার কোণ থেকেও দুটো আরশোলা উড়ে বেরিয়ে পড়লো । মুশকিলে পড়া গেল । একটা অর্ধচেতন আরশোলার মুকাবিলা আর তিনটে আরশোলার পাঙ্গা এক নয় । উড়ন্ত দুটো গিয়ে পায়খানার পৈঠের ওপর আর ফ্ল্যাশের বাক্সে বসলো । এরা কারণে চঞ্চল । হয়তো এরা যুগল , রাত্রে ব্রাশের বিছানায় লীলামগ্ন ছিল । কিন্তু আরশোলা লীলা করলে জীবনবাবু বিলায় পড়ে যাবেন । আরো আরো আরশোলা জন্মাবে । মেরে কুলিয়ে উঠতে পারবেন তো !! চিন্তিত মুখে তিনি প্রথমটার দিকে এগোলেন । ঝঠাৎ করে এক বাড়ি মারলেন । মরল না । ডানধারের পাখনাটা একটু ছেতড়ে গেল মাত্র । সে ব্যাটাও ঝপ করে ঢুকে পরল মগের আড়ালে । আর ঐ ব্রাশ পিটনের আওয়াজে চমকে যুগল আরশোলারা বেভভুলের মত দৌড়লো আনাচ-কানাচ খুঁজতে । জীবন বাবু পৈঠেয় উঠে বাড়ি মারতে লাগলেন । কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি টের পেলেন এত কাছে থাকলে ঝট করে মারা যায় না । নেমে বাথরুমের মেঝেতে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করতে লাগলেন । তিনটে আরশোলা একোণ ওকোণ , এ আড়াল ও আবডাল করছে । পুরনো দিনের মতো দেওয়াল ধরে উঠতে চেষ্টা করছে । পড়ছে , উঠছে , আবার পড়ছে । ছুটতে ছুটতে ঘুরতে ঘুরতে জীবনবাবুর পায়ে গায়ে উঠে পড়ছে । উড়তে গিয়ে মাথায় মুখে ঠোক্কর খাচ্ছে । জীবনবাবু ব্রাশ উদ্দাম চালাতে লাগলেন । আরশোলা তাঁকে মারতেই হবে । নইলে তিনি বাঁচবেন কী করে !! খুব চিন্তিত ও উত্তেজিত জীবন এলোপাথাড়ি বাড়ি মারতে থাকলেন – ঝপ থপ ঝপ থপ