পাড়ার স্বপন । সামনে মামা , আড়ালে পাগলা । আমাদের কাছে তার বিশেষ পারিবারিক খাতির । শুনেছি আমাদের আবির্ভাবের আগে বাড়িতে গরু ছিল । স্বপন মামা , মামাই বলব পরে অসুবিধা হলে অন্য কথা বলা যাবে , বাড়িতে সকালের দিকে আসত । গরুর খানিক যত্ন-আত্তি করে , পুরনো আমলের গভীর ইন্দ্রাগার থেকে বেশ ক’বালতি জল তুলতো । তারপর জল খাবার টাবার খেত । আমরা জ্ঞানত তাকে দেখেছি পুরোদস্তুর বাড়ির অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজের লোক হিসেবে । আমাদের বিছানাতোলা , ঘরমোছা , কাপড়কাচা , উঠোনঝাঁট , প্রয়োজনে মাঝারি কুড়ুলে করে কাঠ চেরাই , লন্ড্রী , যাকে স্বপনমামা এবং আমরা অনেকেই বলতাম ডাইংকিলিং , জামাকাপড় মারবার ফন্দি বোধহয় , সেখানে কাপড় দেওয়া-নেওয়া , অবরে সবরে ঘরের ঝুলঝাড়া ইত্যাদি বহুতর ও বহু ধরনের কাজ করত স্বপনমামা । আমাদের পুরনো যৌথ পরিবারের সদস্য তখন মোটামুটি দশ বারো । বাড়িতে গোটাআষ্টেক ঘর , অনেকগুলো বারান্দা , ছাত । প্রায়ই ছাতের ট্যাংক পরিষ্কার করতে , পাইখানা-বাথরুম পরিষ্কার করতে , কলতলার শ্যাওলা তুলতে আর রোজই কলের জল দিয়ে বাথরুমের চৌবাচ্চা ভর্তি করতে দেখেছি স্বপনমামাকে । এসবের বদলে পুরনো জমিদার চাটুজ্জে অর্থাৎ আমরা তাকে দিতাম দিনে আটআনা , একটাকা পরে যেটা বেড়ে দাঁড়ায় দশ টাকায় একটা , জলখাবার আর দুপুর আড়াইটা তিনটের সময় উচ্ছিষ্ট ও এলেবেলে তরকারি সহ এক কাঁশি ভাত । মাছ মাংসও থাকতো । ভাত খেয়ে উঠে স্বপনমামার পেটটা বেলুনের মতো হয়ে যেত ।
স্বপন মামারা তিন ভাই , এক বোন । বাবার নাম শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় । প্রাইমারি স্কুলের এই মাস্টারমশাই সম্ভবত গত শতকের আটের দশকে প্রাক্তন হয়ে যান । বাজার থেকে খুদ কিনে পরিবারের পেট ভরাতেন । সবাই কিপ্টেমি বলতো । পুরনো লোক । তাই বাড়িও একখানা ছিল পুরনো । পলেস্তারা বলে বাইরে কিছু অন্তত ছিল না । বাড়িতে ঢুকলে ডান হাতে একটা বড় দাওয়া । সিঁড়ি দিয়ে দাওয়ায় উঠে ডানহাতে , বাঁহাতে মোট বোধহয় তিনটে ঘর । দাওয়ার সবচেয়ে শেষে বাঁহাতে রান্নাঘর । স্বপনমামার মা সেখানে লালপাড় শাড়িতে রান্না করতেন । শীর্ণ , তোবড়ানো , জরাজীর্ণ তাঁকে , কোনদিন কোন কারনেই , ভালো লাগেনি । শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় একটা জানালার পাশে বসে দিবারাত্র খাতায় হিসেব লিখতেন । জানলাটা গলি রাস্তার ওপরে ছিল । ঘর সবগুলোই পড়ো পড়ো । তিন ছেলের একটি মুক্ত কিন্তু বাকশক্তিহীন সম্পূর্ণ উন্মাদ , সেটি মেজ । ছোট বুকি আচরণে অল্প ছিট থাকলেও অনেকাংশে সুস্থ । সেই শেষপর্যন্ত কোনরকমে চাকরি-বাকরি জোগাড় করে দেশান্তরী । বড় স্বপনমামা । বুড়ি , একমাত্র কন্যা , চোর , আলসে । কোথাও , কোন দিন , কোন কাজে টিকতে পারেনি । শম্ভুনাথ ও শম্ভুপত্নী এদের রেখেই স্বর্গারোহণ করেছিলেন । সবাই বলতো প্রচুর পয়সা কোথায় যেন জমিয়ে গেছেন । কিন্তু কাউকেই কোন ইঙ্গিত দেননি । কেউ তা পেয়েছে বলেও জানিনা ।
স্বপনমামা সিকি পরিমাণ পাগল ছিলো । চটচট করে মাথা গরম আর কাজে না এসে ঘুরে বেড়ানো এই দুটি ছিল প্রধান পাগলামি । খুব কম বয়সে আমায় বাড়িতে অক্ষর পরিচয় ইত্যাদি করাতে আসতেন আমাদের কুলপুরোহিত , একটি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক , সর্বোপরি আমার ঠাকুরদার বন্ধুস্থানীয় দিনু গাঙ্গুলি । স্বপনমামা কোনদিন তাঁর সামনে বিড়ি খেত না । কুয়োর পেছনে একটা পুরনো , বড় , ছাতখোলা বাথরুম ছিল । সেইটায় ঢুকে পড়ত ।
আমাদের অনেকের মতোই স্বপনমামার ত্রাস ছিল আমার নকাকা ।একদিন বিকেলের দিকে , তিনটে সাড়ে তিনটে বাজে , স্বপনমামা উঠেছে ট্যাংকে ঠিকঠাক জল উঠছে কিনা দেখতে । দোতলার বাথরুমের ওপরে ছিল ট্যাংক । তার সিঁড়ি ছিল না । বড় ছাত থেকে প্রায় ফুট তিনেক পা ঝুলিয়ে নামতে হতো । নইলে দেওয়ালে বের করা আট দশ ধাপ ইঁটে পা দিয়ে চড়তে হতো । কাকারা কেউ ওর ধারে কাছে কখনো যেতেন না । ওটাও স্বপনের কাজ । সেদিনও স্বপন চেপেছে । সেজকাকিমনি বলে কয়ে তুলেছেন । কেউই খেয়াল করেনি আমগাছের ডালে গন্ডা কয়েক হনুমান , পালের গোদাসুদ্দু । গোদা আবার সরকারি বাবুদের মত, দাঁত না খিঁচিয়ে কারো সাথে বাক্যালাপ করতে পারেন না । তিনি বসেছিলেন প্রায় ট্যাংকের উত্তর-পশ্চিমে কোনাকুনি দুশো বছরের পুরনো কাঁঠাল গাছের মগডালে । কাঁঠাল গাছ আর ট্যাংকের মাঝে প্রায় ডেড়শ ফুট ছাদের মাঠ । কী কারনে আজও অজ্ঞাত সেই মহানায়কের তখনই ওই ছাত পেরিয়ে , ট্যাংক পেরিয়ে উল্টোদিকের আমগাছে আসার দরকার হলো । তিনি হাফঘোড়া , হাফবাঁদরের চালে হেঁটে এসে দেখলেন স্বপনকে ট্যাংকে মগ্ন । সামনে বাধা থাকলে বিপত্তি । তিনি দাঁত খিঁচিয়ে ছাড়লেন…খ্যাঁকর খ্যাঁক …মহা হুঙ্কার । আমরা ছিলাম ট্যাংকের পাশে লাগোয়া ঘরে । ওদিকে খ্যাঁকর খ্যাঁক আর এদিকে ঘরের পাশের ছাদে ‘দুম ধড়াস’ !! কী হলো কী হলো !! স্বপন মামা বাথরুমের আট ফুট উঁচু খোলা ছাত থেকে হনুমানের ভয়ে পড়েছে নিচের ছাতে । বাঁ কাতে পড়েছে । সাড়া নেই , শব্দ নেই । আমরা হতভম্ব । সেজকাকিমনি কপাল চাপড়াচ্ছে । গভীর গুঞ্জন ‘ মরে গেলে কী হবে ??’ আমরা ছোট । কাছে কেউ এগোচ্ছে না । কাকা , কাকিমনি , ঠাকুমা সবাই একটু তফাৎ রেখে দেখছেন । ওর গায়ের গন্ধে ভূত পালায় । নামমাত্র চান করে কি করে না !! নোংরা জামাপ্যান্ট । গায়ে হাত দিয়ে তুলতে সবাই পিছপা । সেজোকাকা খুব সন্তর্পনে নাকের কাছে হাতটা নিলেন । নাহ্ নিঃশ্বাস পড়ছে না ।
ওরে বাবারে কী হবে গো ??
এই স্বপন ওঠ ।
ও মামা , মামা , লেগেছে ? কী হয়েছে ?
স্বপন কথা বল ।
সাড়া দিচ্ছে না যে !
এই স্বপন…স্বপন…
মামা ও মামা…
ইত্যবসরে আসরে এলেন আমার নকাকা । এসেই বাজখাঁই গলায় চিৎকার ছাড়লেন
এই স্বপন , কী হয়েছে তোর ? ওঠ , ওঠ বলছি ।
স্বপন মামা মরেনি । কোন কারণে সেজোকাকা নিঃশ্বাস বুঝতে পারেননি । নকাকার খানিক গলার কসরতের পরেই উঠে বসে , জল খেয়ে , ব্যাথায় মলম লাগিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল । আবার পরের দিন লজ্জালজ্জা মুখ করে গেটের ধারে বড় বেল গাছটার নিচে ঘোরাঘুরি করছিল ।
আজ স্বপনমামা কর্মহীন , অশক্ত , প্রায় ভবঘুরে । যদিও ওর ভবের চৌহদ্দি পাঁচ কিলোমিটারের বেশি হবে না । কোনো ধরাবাঁধা কাজ করতে কোনদিনই তার মন মানেনি । বহু লোকের বাড়িতে বহু কাজ ও সামান্য দু পাঁচ টাকায় বা দুটো বিড়ির দামে করে দিয়েছে । আমাদের ছাড়া কোন বাড়িতে কোনদিন কেউ ওকে পেট ভরে খেতেও দেয়নি । আমি দেশান্তরী । কিন্তু ভাই তাকে নিত্য ডাকে শুধু খাবার দেবার জন্য । আসে না । মানুষের মিষ্টি কথাকে ও ভয় পায় , ভাবে সবই মুখমিষ্টি , কাজ করিয়ে নেওয়ার ধান্দা । দুনিয়ায় এখন ওর গভীর অবিশ্বাস । আমাকে ডাকে ‘বড় মাস্টার’ । যেহেতু আমরা দুই ভাইই ইস্কুলে ছাত্র পড়াই ।
এবার লকডাউন কদিন আগে বাড়ি ফিরেছিলাম । ইতিউতি করে ভাগ হওয়া বাড়ির আমাদের দিকে গেটে এসে ডাকলো ‘বড় মাস্টার’ । অনুচ্চকিত গলা , বড়ই আন্তরিক । আসলে দু’চারটে টাকা । দিলাম যা হোক । প্রতিবারই দি । কিন্তু এবার মনে ধাঁ করে বাজলো একটা অদ্ভুত কথা । জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের নিকট সম্পর্কের ভাগ্নে ছিল স্বপনমামা ।
ওকে কেউ কোনদিন কিনতে পারেনি