সিট
সালা!! সকাল বেলাই মোটাটা এসে বসেছে । একটু দম নিতে পারছিনা । রোজ সকালে ট্রেন থেকে নামবে সবার পেছনে । কেউ তো সামনে আসতেই দেয় না ওটাকে । আটকে দেয় তো পুরো ! শেষে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নেমে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়বে । ও ভাবে দৌড়াচ্ছে কিন্তু লোকে মোটেই ভাবেনা । এখন তাও সেই মেশিনের সিঁড়ি হয়েছে , ওতে করে এক নম্বর প্লাটফর্মে নেমে তবে বাইরে আসে । ছুটে এসে ধপ করে বসে পড়ে । আমি রোজ আড়ে আড়ে তাকাই । ভগবানকে ডাকি । পাশেই দু’চারটে মন্দির নতুন হয়েছে । ‘আজ যেন মালটা না আসে , কামাই করে’ । কিন্তু কামাই করে না । হাঁপাতে হাঁপাতে ঠিক আসে । টেরা মাল । কিন্তু ঠিক দেখি একই জায়গায় বসে পড়ে । নাকি ওর নামতে সুবিধে হয় । হবেওবা । আমায় তো নামতে হয় না ।
আজও এসেছে , বসেছে । কোনদিন সুতির প্যান্ট পরে না । গ্রীষ্ম বর্ষা শীত সর্বদাই মেশানো কাপড়ের প্যান্ট পরবে ! ঘেমে ঘেমে পাছায় সাদা সাদা দাগ পড়ে যায় । কিন্তু সুতি পরবেনা । ও নাকি জোটাতে পারেনা ! পাইমারি ইস্কুলে মাস্টারি করে । বাবা-মা-বউ-বাচ্চা । জমিজমা গ্রামের দিকে যা ছিল বিক্রি করে দিয়েছে । জমির কিচ্ছু আয় নেই । বহুদিনই নাকি ঘুচে গেছে । এখন যা সব ওই ইস্কুল । তবু চেষ্টাও করেনা বদলির । আরে বাড়ির কাছে গেলে আসা যাবার খরচ বাঁচে ! বদলি হবেই বা কী করে !! একা মাস্টার ইস্কুলের । কিন্তু কোনদিন কোনদিন তো ট্রেন মিস করতে পারে , বর্ধমান স্টেশনে ওভারব্রিজে আটকে যেতে পারে , পায়ে পিষে যেতে পারে … কিচ্ছু হয়না । ঠিক আসে আর ঝপ করে বসে । ভীষণ লাগে মাইরি । ওরম গোদা পাছাটা দিয়ে বসলে লাগবে না !! কিন্তু সহ্য করতে হয় । প্রতিবাদ করার উপায় নেই । ওউ যেতে বাধ্য, আমিও । পালানোর কোন উপায়ই নেই ।
মাস্টার
দেখেছো ! সেই ছেঁড়াটা রিপু করায়নি । ‘ও বিশুভাই , বললাম না মাথার পেছনে ছিঁড়ে ঝুলছে ! রিপু করাও’ । ভাগ্য বটে আর এই দশ বছরে একটাও নতুন বাস হলো না ! আরেকটু গদির সিট, ছড়ানো , পিছনে খোঁচড় নয় , সেই দশ বচ্ছর এক বাস এক সিট ধরে যাচ্ছি । কোন কোনদিন পাই না । ওই পালা-পরব-শালপুজো এসব থাকলে বিশু এ সিটটাও বেচে দেয় । বলে ‘ আজকে একটু কষ্ট করুন মাস্টামশাই ! হল না ।’ কিন্তু দূরের যাত্রীকে দেয় না । আট-দশ কিলোমিটার পরেই বসতে পাই । আগে মুখের কথায় কেউ বলেও দেয় না সিটটা । ডেলিরা জানে আমি আসবো , বসবো । বেশি দাঁড়াতে পারি না । এই চেহারাটার জন্য সবাই মায়া করে । রোজ আসি । একটা স্বাভাবিক অধিকার জন্মে গেছে । আর এ সময়টায় বাসও নেই । কিছু করার নেই । এর আগেরটা অনেক আগে । পরেরটা অনাথ মানে লেটের মা-বাপ নেই । তাই এটাকে ধরে আছি । এমন হয়েছে বাস স্ট্যান্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেছে , টোটো করে গিয়ে রাস্তায় ধরেছি । জানি পাইকারি মার্কেটের জ্যামে দাঁড়াবে । দেখেছি বিশু টিকিট কাটা শুরু করেনি , আমার সিটটায় বসে আছে । সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় । ‘বসুন মাস্টামশাই’ । আসলে চেহারাটার জন্য সকলে মায়া করে । সবারি তো তাই না কি!!
সিট
শুনেছি আজকাল সিজারে চিটপটি মেরে দেয় । সেলাই করে না । মাস্টার আমায় তাই করেছে । কাল একটা মোটা খয়েরি রঙের চিটপটি বের করল , কাঁচি বের করল ,কাঁচি দিয়ে খানিকটা চিটপটি কেটে ছেঁড়াটায় ঠিক লাগিয়ে দিলো মাইরি ! টেরা হলে কী হবে দেখতে ঠিকই পায় । নইলে রোজ এসে এক জায়গায় বসে ! আস্তে আস্তে আমার খোলের মাপ ওর পাছার মত হয়ে গেছে । কিন্তু জন্মদোষ কিছু তো থাকেই । বছর বারো আগে পানাগড়ের গ্যারেজে বাস ফিটিং এর সময় আঠারো ইঞ্চির মধ্যে প্রথমে করেছিল । পরে আরো একটা জোড়ে । সেটাই আমি । একই সাইজ, নইঞ্চি । ওটা তো আমি টেনে বাড়াতে পারবো না । তবুও মাস্টার বসে বসে একটা সেপে এনে দিয়েছে । ঠিক বছর দশ আগে পানাগড়ের গ্যারেজে আমার মতো আরো সাতটা সিটের জন্ম হয়েছিল । লোক বেড়ে যাচ্ছিল । বসতে না পেলে সত্যিই যেতে চাইছিল না কেউ । দূরে দূরে যাবে । যাওয়া যায়না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ! বাস মালিকরা ধড়াধ্যাড় বসে সাতটা আটটা নতুন সিট লাগিয়ে নিল । পারমিট ফার্মিট ঝামেলা কিছু হয়েছিল কিনা জানিনা । কিন্তু বাঁধা আয় বাড়ল । আমাদের জন্মই তো বেশি লোড সামলাতে । সামলে যাচ্ছি । রা কাড়িনা । ক্যাঁচকোঁচ নিজে থেকে করিনা । গত বছর একটা নাট ঢিলে হয়ে গিয়েছিলো । তখন একটু নড়াচড়া করেছি । তাও দুদিন বাদেই মালিক নিজেই স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে চেপে বসিয়ে দিল । যাতে দুলতে না পারি । দুলিনা । ঠিক গ্যাঁট হয়ে এক জায়গায় বসে কাজ করে যাচ্ছি ।
মাস্টার
ডেলিরা আমায় আজ বেশ আওয়াজ দিয়েছে । আমার চিটপটির কাণ্ডটায় খুব হইচই । কিন্তু রোজ ওভাবে ঘাড়ের কাছে সুড়সুড়ি খেতে ভালো লাগে ! তাই বাধ্য হয়ে । যাক আমার স্কুলে কাল থেকে আধঘন্টা বাদে শুরু করব । চাষ লেগে গেছে । ধান রোয়ার কাজে কচিগুলো মাঠে এটা-ওটা বইতে যায় । যে পারে আগে আসে নয়তো পরে আসে । বলি ‘এলেই হল , কামাই করিস না ‘ । সরকার যখন প্রথম দুপুরে মিড-ডে-মিল চালু করল , লোকে খুব গালমন্দ করল । আমারও প্রথমটা কেমন কেমন লাগছিল । কাজ বাড়লো । কিন্তু দেখলাম ছেলে মেয়ে একটু একটু করে সত্যিই বাড়লো । শুকনো কলসির বাইরের দিকে জল ঢালতে ঢালতে ভিতরটাও একদিন ভিজে যাবে । গ্রামের লোক খুবই হারামি বজ্জাত । এক কথার এক মানে করে । অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী । কিন্তু আমার সাথে লাগতে আসে না । আমি সবে থেকেও কিছুতে থাকি না । নিজের কাজ যতটা মানুষের পক্ষে সম্ভব করি । হ্যানত্যান অফিস সামলে পড়াতে পাই কতটা ! তবু ছাড়ি না ! দেরি করে , এস আই অফিস ঘুরে , অনেকদিন স্কুল যেতে হয় ! তবু যাই । পালাই না । জানি পালালে হবে না । নিজের হাতের সইয়ের খাতা থাকলেও নয় । ছেলেমেয়েগুলো খুব খারাপ পরিবেশে থাকে । একটু ভালো গল্প ছবি কার্টুন গান যেটুকু জানি ওদের বলি । যদি একটু এগোয় ! ছেড়ে যেতে পারবো না । প্রথম প্রথম একাবোকা খুব খারাপ লাগত । দুইএকবার বদলির অ্যাপ্লিকেশনও করেছি । হয়নি । সে ভালই হয়েছে । অন্য জায়গায় অন্য ঝামেলা থাকবে । অচেনা ঝামেলার চেয়ে চেনা ঝামেলা ভালো । জানি আটকে গেছি … কিন্তু কাউকে কাউকে তো আটকে থাকতে হবে , নইলে এগোবে কি করে !!