বেঁটেহাবুর বাবা শ্রীযুক্ত কানাজীবন ডাকের কর্মী । প্রতিদিন চুঁচড়ো অফিস । জনশ্রুতি যে ডাকঘরের দেয়াল হবার ইঁট থেকে প্রতিদিন দুহাতে দুটো বয়ে এনে পাড়ার রাস্তা থেকে বাগানটাকে তিনি আলাদা করেন । স্ত্রী পদ্মরানি দজ্জাল ও জাঁদরেল । তাঁর প্ররোচনায় পূর্বোক্ত হাবু একদিন পিতা-পুত্র সংঘাতে অরণ্যদেব হন । ঘুঁষির ধাক্কায় আংটির ক্ষত বসান জীবনবাবুর ডান চোখের ওপর । তাই ‘কানা’ । আসলে অঙ্গুরিঘাতে ডান চোখের উপরের মাংস খুলে খানিকটা ঝুলে গেছিল । ওরম দেখাতো ।
জগদ্ধাত্রী পুজোয় ধুম খুবই বেশি । ছোটবেলায় দেখেছি বিরাট ভাঙ্গা খিলানের এক পূজাগৃহ । আগাছাধিকৃত । খিলানের বহর তার এককালীন উজ্জীবনের স্মরণ । এখন যেখানে পুজো হয় সেটা ছোট ছোট তিনটে খিলানে ভাগ করা ফুট পনেরো উঁচু একটা কোঠা । কড়িবর্গার আলকাতরা আর দেওয়ালের অ্যালা সন্ধ্যের জেনারেটরের আলোয় ঝলসে ওঠে । মায়ের সাজের রুপালি ছটা , বড় ধুনুচির ঘন ধোঁয়া , অপরিসর মন্দিরগৃহে লোকারণ্য ,আরতির গাঢ় চলন ঘন্টা-কাঁসর-ঢাকের ঘন গভীর ও সুশৃঙ্খল আর্তনাদে ভক্তের বিহ্বলতা ও স্থবিরতা এককথায় । প্রতিবার দশমীর দিনে সিদ্ধির মহান ঐতিহ্য জীবন নিষ্ঠায় পালন করেন । একবার লালুর বাবা সিদ্ধি বলে পেঁপের আঠা খাইয়েছিলেন । কিন্তু বাওয়াল দেখে কে বলবে !! সিদ্ধ ও আবেশাতুর অবস্থার সমস্ত প্রভাবই জীবন প্রবল প্রকাশ করেন । ঘোর দেখাতে গিয়ে সাদা ফতুয়ার নিচের দিকটি ছিঁড়ে যায় । স্ত্রী পদ্মরানি রেয়াত করেননি । পরের সাতদিন জীবনেন্দ্রনাথ শুধু গেঞ্জি পরে অফিস করলেন ।
জীবন বাঁড়ুজ্জের শখ ছিল সে তো বিদিত , সাধও ছিল বোধহয় । নইলে নিজের হাতে সে পুরনো জগদ্ধাত্রী দালানের সামনে বকুল গাছ বসাবে কেন ! জীবন তখন বেকার । পুরনো বাড়ির থার্ড ক্লাস পাস ছেলে । রথের মেলা ছোট হত , কিন্তু প্রভাবে এত বড় ছিল আজ তা অকল্পনীয় । দে-দের বিরাট দালানের সামনে অজগর মিঞা অজস্র গাছের চারা বেচতো । বেশি আম কাঁঠাল । কালো রংয়ের ত্রিপল টাঙ্গানো বাঁশের খাঁচার নিচে মাটিতে রথের বৃষ্টির জল বইলে গাছগুলো মোটামুটি ডাঙায় সরাতে হত । কিন্তু বকুল তো ফল নয় , অতি কাব্যিক ফুল । জীবনেন্দ্রনাথ সাধ করে তাই আনে । বসাবার জায়গাও মেলে দারুন । বাড়িতে অত বড় গাছের জায়গা হয় !! আর বাগান সে তো দূর্গার আম কুড়োনোর বাগান । অত গাছের আওতায় বকুল হবে না । তাই তখনকার জগদ্ধাত্রীতলার সামনে । প্রথম দু চার বছর একটা ইঁটের ঘেরা ছিল । বিশ্বাসদের বাড়ির ইঁট । ওরাই করে দিল । গাছ টিকে গেল । জীবনেন্দ্রনাথ সাকার হলেন । গাছ বাড়লে ইঁটের বেড়া উধাও হলো । জীবন গাছটা চোখের আড়াল করতেন না । পাড়ার একটা স্থানচিহ্ন হতে বকুল গাছের দশ বছরের বেশি লাগেনি । বলে বকুল গাছ আস্তে বাড়ে । জানিনা সেটা ওই গাছটা নয় ।
আর এক জগদ্ধাত্রী পুজোর সকাল । বকুলের তলায় দাঁড়িয়ে , মোটেই রোম্যান্টিক নয় , পাড়াপরিচয় চলছে । জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রায় বছর সাতেকের স্থায়ী সম্পাদক শতদল ডাকের নতুন পিওনকে পাড়ার সকলের নাম ও ধাম চেনাচ্ছেন । এগলি-ওগলি-মোড়-চৌরাহা সব পাখি পড়ানো করে শতদল অম্লানবদনে প্রশ্ন করলেন
‘আপনার তাহলে কত চাঁদা কাটবো’
পিয়ন অপ্রস্তুত । কিন্তু উপকারীকে অস্বীকার করা ! তাই
‘ ওই একুশটাকা কাটুন ‘
পাড়ার কচিছেলেরা নতুন সরস্বতী পুজো চালু করল বকুলতলায় । পুরুত ডাকার ঝঞ্ঝাট ছাড়া সেখানে কোনো অসুবিধে নেই । এমনকি পাড়ার কাকুরা সন্ধ্যেবেলায় এসে একটা খিচুড়ি ভোজনের আয়োজন করে দিলেন । সরস্বতী প্যান্ডেলের মূলসজ্জা !! বাবার হাতের গাছের পাতা দেদার লাগাতে জীবনের জ্যেষ্ঠপুত্র মোটেই দ্বিধা করেনি । পাড়ায় জগদ্ধাত্রী পুজোয় শ্যামা , চণ্ডালিকা সবই বকুলের দান , মানে বকুলের মালা ছাড়া নাটকের মেয়েদের সাজসজ্জা তো হতোই না । গাছটার তলায় বর্ষার এক ইঞ্চি পুরু পড়ে । বিশ্বাস বাড়ির কাজের বউ ঝাঁট দিয়ে কুল পায়না । পাগলা বিড়িখোর ছনা দুপুরের খাওয়া সেরে রাস্তায় ওর নিচে বসে । দিন যায় । জীবনেন্দ্র ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়েন , গাছ ঋজু হয়ে ওঠে জীবনেন্দ্র ঘাড় তুলে চোখের আড়াল দিয়ে না দাঁড়ালে তার মাথা দেখতে পান না । ব্যান্ডেল স্টেশনের নিচ থেকে রোজ ধারে বা অন্যের ঘাড়ে খাওয়া বিহারী খেনুরামের তেলেভাজা অবসরের পরে পেটে গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়ে পুনর্জীবিত হলো । আলসারের যন্ত্রণাতেও ভরপেট ঠান্ডা জল খেয়ে দুপুরের রোদ পড়লে জীবন ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বের হন । আলো হাতের চেটোতে আটকে বকুলকে দেখেন । উঠতি কারবারি শিবেন সাইকেলে যেতে যেতে ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে বলে
‘দাদু কী দেখছ??’
জীবনকে বিছানায় না দেখে দাঁত কসকস করে গাল পাড়েন পদ্ম ।
‘এখনও গাছ দেখার সাধ !!?? শিগগির ঘরে যাও , ঘরে যাও ‘
শিগগির জীবন পিছু হটেন । আলসার ও অন্যান্য আরো কিছু দূতের ডাকে সাড়া দিয়ে ওই বকুল তলা দিয়ে স্বর্গদর্শনে বেরিয়ে পড়লেন শ্রীযুক্ত জীবনেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । বকুল বিমর্ষ হয়ে পড়ে । শতদল বসের আহ্বানে দেশান্তরী , কচিরা পরিপক্ক , কলেজে ইউনিভার্সিটিতে জ্যান্ত বিদ্যায় মাত , কাকুদের কারো স্ত্রীর অসুখ , কারো কিশোরী কন্যা পলাতকা , কারো পুত্র মদগর্বী … এককথায় পাড়া ছত্রখান । বকুল আকাশে মুখ উঁচু করে । পায়ে জল শোষে আর ডালে ফুল ধরায় । জীবনের বাকি ইতিকর্তব্য থেকে সে তফাৎ । যথারীতি পুজো হয় । জগদ্ধাত্রী মন্ডপ ইতিমধ্যে ঝকঝকে হয়েছে । পুরনো কড়ি বর্গা আলকাতরা ফেলে পথের ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে । দূরাগত শতদলের মিনতি ‘ওই ইঁটগুলো রাস্তায় লাগাবেন না’ কেউ শুনতে পায়নি । পুজোর দালান এখন রীতিমতো মন্দির । সিঁড়ি মোজাইকের , ছাদ কংক্রিটের , দেওয়াল পুটটির । পুজোর মিটিং বসে কালীপুজোর দিন পনেরো আগে । কালীপুজোর পর আর সময় থাকে না । ইতিমধ্যে ওই বকুলের ধারে শিবানন্দের ধানভাঙানো খুলল । শিবানন্দ মানে শিবেন বালির মাঠের লোক । খুব কম বয়স থেকে অত্যন্ত উদ্যমী ও বুদ্ধিমান । অস্তমিত জমিদারের আমবাগান বছরের ডাকে নিয়ে ব্যবসায় । কারবারের দিকে মুখ করতে গিয়ে বাড়ির দিকে শিবানন্দ পেছনে ফেলে । লোকে বলে ‘রাজার মায়ের ছেঁড়া ত্যানা ‘ । সে যাহোক আম থেকে ধান , ধান থেকে লরি , লরি থেকে জমি এসব পেরিয়ে আজ একটা দেখসে দেখসে ব্যাপার শিবেন । কে বলবে মাত্র বিশ বছর আগে ওরা সব হারিয়ে এপারে এসেছিল । মুখের গড়ন ভালো , নাতিদীর্ঘ , কুচকুচে কালো চুল , মেদহীন শিবানন্দ পয়সায় যত বাড়ল , পাড়ার ঠেকে তার খাতির তত বাড়লো । ওখানে পার্টির কাকু-জেঠু-মাস্টামশাই বসতেন । তাদের কাল গত হলে দাদা ও ইয়ার-দোস্তদের কাল এলো । মোড়ের নতুন স্টারালো ক্লাবের কালীপুজো চালু হলে প্রধান পৃষ্ঠপোষক এর নামটা সর্বদাই ‘সর্বশ্রী শিবানন্দ বিশ্বাস’ চালু হলো । পুরনো পাড়ার সাথে ওই কালীপুজোর কোন সম্পর্ক নেই ।
জগদ্ধাত্রীপুজোয় শতদলের সঙ্গে যিনি যৌথ সম্পাদক হতেন , শতদল দেশান্তরী হতে তিনি এখন একমাত্র অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয় সম্পাদক । হঠাৎ লক্ষ্মীপুজোর ক’দিন বাদে দারুন বৃষ্টি । জগদ্ধাত্রীর মিটিং এর দিন সকালেও বৃষ্টি হচ্ছে । আগের দিন প্রচার হয়ে গেছে মিটিংয়ের । ছোট ছোট জেরক্স করা চিঠি বাড়ি বাড়ি গেছে । একবার ভাড়া করা মাইকে করে হাঁকা হল । কেন কে জানে মোড়ের মাথার সব লোক ঝেঁটিয়ে সেদিন মিটিংয়ে এসেছে ! শিবানন্দ এসেছে , মোহন মালো অতি উৎসাহী হয়ে এসেছে । এরা কোন জনমে তো মিটিংয়ের ধারায় না !! মোহনের গলা মধুর মত সভায় ঝরে পড়ে
কাকা একটা কথা ছিল
হ্যাঁ বল
বলছি যে পুরনো জগদ্ধাত্রী তলার মাঠটা তো পড়েই আছে
হ্যাঁ ওখানে বুড়ি পাগলি ঘুটে দেয় তো
হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা… যেন খুব একটা হাসির কথা
তো শিবেন বলছিল…আপনাকে নিজে থেকে বলতে সাহস করছে না
হ্যাঁ বল না , তুইই বল
মানে ওই মাঠটা পেলে ওর ধান শুকোতে সুবিধে হতো
ওটা তো আমার জিনিস নয় পড়ার পাঁচজন যা বলবে
না কাকা কথাটা ঠিক তা না
শিবানন্দ চৌকস করে বলল
মানে মাঠটা আমি কিছু মাটি ফেলে সিমেন্ট করে বাঁধিয়ে নেব । ওটার দরুন বছরে আমি একটা থোক টাকা পুজোর চাঁদা দেবো
শিবেন , মাঠ নিয়ে টাকা দেওয়া কে চাঁদা দেওয়া বলে না । ভাড়া দেওয়া বলে
না না কাকা ছি মায়ের জিনিস ভাড়া নেবার ক্ষমতা আমার আছে!!?? আমি বছরে তিনহাজার টাকা মাকে পুজো দেবো
মনা , শিবা ও পাটির একপাল জারজ সন্তানদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে টাকাটা পাঁচহাজারে উঠলে প্রতিমার কাঠামো হাঁপ ছাড়লেন । পুজোর মাতব্বররা কম খুশি নন । পড়ে থাকা মাঠের বদলে প্রতি বছর পুজোয় পাঁচহাজার !! মন্দ নয় , মোটেই মন্দ নয় ।
বাকি মিটিংয়ে হরিবোল । যথাপূর্বং । বরং এবছর পাঁচহাজার টাকা বেশি ও হাতে হাতে আদায় । মনা শিবেন ও পার্টিগুষ্টি বীরের চলনে সভা ত্যাগ করে । বিকেলের মিটিং গলে সন্ধ্যে হলে ফিরতে ফিরতে সেই পোড়ো মাঠটা দেখি । বুড়ি পাগলি ঘুঁটে তুলছে , বকুলের ছায়া অন্ধকারে মলিন হয়েছে , গাছে পাখি ডাকছে , মাটিতে ইতিউতি ঝরা বকুল । খুশিই হওয়া উচিত বোধহয় !! পুজো মিটলো । তার আগে মিটিংয়ের কাগজে জমি ইজারা এসব চুকলেই শিবানন্দ মাঠ বদলে মেঝে করে ফেলল । জগদ্ধাত্রীর পুরনো দালান অনেক ইঁট দান করে মাটিতে মিশে গেল । ধান বস্তা বস্তা শুকোতে থাকে । কিন্তু এ কী !! বছরে পাঁচহাজার টাকার বদলে ঝাঁকড়া বকুলের ছায়া !! এ তো অসহ্য । হাত ছেঁটে বকুলকে ধাতস্থ করা হলো । কিন্তু ওটা থাকলেই তো মেঝে ফাটিয়ে দেবে । পাড়ার কজন বুড়োর দুর্বল প্রতিবাদ মনার নেতাগিরিতে ফুস হয়ে গেলে এল বিরাট দাঁতওয়ালা বিরাট করাত । দুদিকে মোটা লোহার হাতল । তার যা বেড় , দুজনে ধরতে হয় । তলতা বাঁশের মত মোটা দড়ি গাছের বুক বরাবর বেঁধে পেট বরাবর ঘ্যাসঘ্যাস করে করাত চালালো মুশকো মুশকো জোয়ান । সব দিক থেকে ঘুরে ঘুরে মাপ করে কেটে মাঝখানে সিধে রেখে আবার পোক্ত দড়ির প্যাঁচ । জনা ছয়েক কোমরে দড়ি বেঁধে জগন্নাথের রথের মতো টেনে ধরলো একদিকে , চার-পাঁচজন হাতের জোরে মারল ঠ্যালা…হাঁইও হাঁইও হাঁইও …চড় চড় চড় চড় গোড়া থেকে হুমড়ি খেয়ে বকুল পড়লো লাল মোরামের রাস্তায় । পাখিগুলো ওপরটা ঘুরে ঘুরে চেঁচাতে লাগলো । একটা কটকটে নীল রঙের ফাঁকা আকাশ বেরিয়ে পড়ল , কোথাও মেঘ নেই । পদ্মরানির সতীন তাঁর জীবনের একরকম সহমৃতা হলেন ।
বকুলের দেহবেচার ছহাজার শিবেন পর বছর পুজোর ভোগে দেয় । কিন্তু মা জগদ্ধাত্রীর পেটে ও ভোগ সহ্য হয়ে ছিল কিনা তা অবশ্য মিটিংয়ের খাতার কোন পাতাতেই নেই