উঠানে দড়াম করিয়া কিছু ভারী জিনিস পড়িবার শব্দ হইল। সংলগ্ন ঘরগুলির মধ্যে ভীষণ গুমোট অন্ধকার চাপিয়া বসিয়া আছে । এমনভাবে আলোকের প্রতিটি প্রবেশদ্বার রুদ্ধ যে শঙ্কা হয় এই ঘরে কোনদিন আলো প্রবেশ করে নাই বা করিবেও না । এই ঘরে যে মানুষ বাস করিতে পারে তাহা কল্পনারও অযোগ্য । কিন্তু মানুষ ছিল । তাহারা কিছুদিন যাবৎ যে আলোককে একটা যমের মত শত্রু ভাবিতেছিল । গ্রামে জাতিদাঙ্গা শুরু হইয়াছে আজ প্রায় মাস তিনেক হইল । পুলিশে পুলিশে চারিদিক ছয়লাপ হইয়া গিয়াছে তাহাও প্রায় মাসখানেক।
উঠানের শব্দের খোঁজে একখানি কালো শীর্ণ মুখ ডান দিকের ঘরের দরজা ফাঁক করিয়া বাহির হইল । সে বিপিনের মা । পুলিশের নাইট ডিউটির টহল চলাকালীন একটা অস্পষ্ট কোলাহল সেও শুনিয়া ছিল কিন্তু কিছু ঠাহর করিতে পারে নাই । চন্দ্রহীন রাতেরও যে মায়াময় এক ধরনের আলো তাহাতে সে দেখিল উঠানে একটি বড়োসড়ো চেহারার মানুষ নিস্পন্দভাবে পড়িয়া আছে । বিপিনের মাও খানিকক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল । করণীয় কিছুই সে স্থির করিতে পারেনা । বিড়ালের মত সময় বহিয়া যায় । একঘটি জল নিয়া প্রায় তেলহীন হারিকেনটিকে কোনক্রমে জ্বালাইয়া সে উঠানে আসে ।একটি যুবাবয়সী পুলিশ উঠানে উপুড় হইয়া পড়িয়া আছে ।
সাজগোজে বেশ পারিপাট্য রহিয়াছে । কোন সাড়াশব্দ নেই । বিপিনের মা ভয় পাইল । কিন্তু ওই অবস্থায় ছেলেটিকে ভাগ্যের হাতে ছাড়িয়া দিতে তাহার মাতৃহৃদয় সায় দেয় নাই । সে কাছে আসিয়া দুচারবার ছেলেটির গায়ে মৃদু ঠেলে দেয় । পুলিশটা কি মরিয়াই গিয়াছে !! কিন্তু পুলিশের লোক মরিলেও বিশ্বাস নাই ! তাহার উপর তাহাদেরই উঠানে মরিলে কোর্ট-কাছারির প্রসারিত হস্তের কৃপাস্পর্শ তাহারা নিশ্চয়ই পাইবে , ইত্যাদি ভাবিতে ভাবিতে সে দুই-তিনবার জলের ছিটা পুলিশটির মুখে দেয় । কয়েকবার এমন করিতেই পুলিশটি নড়িয়া সংজ্ঞা পাইয়া চেতন হইল ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল । এদিক-ওদিক হাত রাখিয়া অতি সাবধানে কী খোঁজে । বিপিনের মা তখন উঠিয়া দাঁড়াইয়া সরিতে গেলে তাহার পায়ে ঠেকিল পুলিশটির রাইফেল । পুলিশ চিৎকার করিয়া উঠিল ‘সাবধান রাইফেল কক করা’ । বিপিনের মা সন্ত্রস্তভাবে দাঁড়াইয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া চায় । বন্দুক সে এই দাঙ্গার কল্যাণে অনেক দেখিয়াছে , কিন্তু এ সম্বন্ধে তাহার কোন ধারনাই নাই ।
পুলিশটির তখন সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরিয়াছে । অতি সন্তর্পনে সে বন্দুকটি সামলায় । আশ্চর্যভাবে বিপিনের মাকেও আশ্বস্ত করে । বিপিনের মা এইটুকু প্রশ্রয়কেই অনেক ভাবিয়াছে । আহা ছেলেটি তাহার বিপিন এর বয়সীই হইবে । বিপিনকে সে কতদিন ভালো করিয়া দেখে নাই । বনেবাঁদাড়ে , রাতের অন্ধকারে , ধানক্ষেতে লুকাইয়া পলাইয়া বেড়াইতেছে আজ প্রায় আড়াই মাস হইলো । মাঝে মাঝে দুপুরবেলা চোরের মতো চুপি চুপি আসে দুইটা ভাত খাইয়াই , তৎক্ষণাৎ পালাইয়া যায় ।
বিপিনের মা পুলিশকে দু-চারটি ঘরের কথা জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারে সে এই কাজে নতুন কাজী । সবে জয়েন করিয়াই উপরওয়ালার আদেশে সে এই জাতিদাঙ্গার মধ্যে প্রেরিত হইয়াছে । কিছুক্ষণ আগে ক্ষেতের ধারে , বটগাছের নিচে একটি ছোট জটলা হইয়াছিল । সেটিকেই ছত্রভঙ্গ করিতে গিয়া সে দূরাগত ইঁটের আঘাত বুকে পায় । বুকের প্রচন্ড ব্যাথায় সে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া এইখানে আসিয়া পড়িয়াছে । এত পর্যন্ত বলা হইয়াছে হঠাৎ উঠানের দরজা দিয়া অতি ধীরে , প্রায় জোর ফিসফিসানির মত ‘মা’ বলিয়া বিপিন আসিয়া পড়িল । সঙ্গে সঙ্গে বিকট আওয়াজে আর ধোঁয়ায় আকাশ বাতাস চমকাইয়া উঠিল । দরজার সামনেই উপুড় হইয়া মাটিতে পড়িয়া যায় বিপিন । পুলিশটি দ্বিতীয়বার গুলি করিবার জন্য বন্দুকটি কক করে কিন্তু নিজের অজান্তেই বন্দুকটি মাটিতে রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া অগ্রসর হয় । পুলিশ দেহটা পায়ের শক্ত বুটে নাড়াইল কিন্তু ক্ষীণপ্রাণ বিপিন ততক্ষণে ইহজগত ছাড়িয়াছে ।
পিছনে কিছু অস্পষ্ট শব্দ পাইয়া পুলিশ পিছনে চাহিয়া বিস্ফারিত হইয়া গেল । কক করা রাইফেলটি তাহার দিকে তাক করিয়াছে দুর্বলহস্ত বিপিনের মা । সে লাফাইয়া , চিৎকার করিয়া প্রশিক্ষণজাত আত্মরক্ষার সমস্ত চেষ্টাই করিত । কিন্তু ততক্ষণে মা বন্দুকের ঘোড়া টিপিয়া দিয়াছে।