জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রিতে কুয়ার ধারে দাঁড়াইয়া সে তাহার তিন মাস সতেরো দিন বয়সী মাজা রংয়ের নধর পুত্রসন্তানটিকে প্রগাঢ় চুম্বন করিল ।
হে প্রাণপ্রিয় সস্তা খেউরের রসিক পাঠক , আমাদের ফট করে ফুটে উঠে ঝপ করে ফুরিয়ে গেল গল্পমালার উনপঞ্চবিংশৎ গল্পে আপনাকে স্বাগত জানাই । এ গল্প এমন একটি মেয়ের দাঁত ওঠার আগে যার নামকরণ হয়নি । নগা মন্ডলের ষষ্ঠ কন্যার নামের প্রয়োজন বহুদিন অনুভূত হয়নি । কারণ কেউ তাকে ডাকতো না । দাদু ঠাকমা তার বহু আগে জগত মদ্যের মায়া ত্যাগ করায় আদর করার কেউ অবশিষ্ট ছিল না । তাই শোয়া থেকে উল্টোনো , উল্টোনো থেকে কুক্কুরীমুদ্রা , কুক্কুরীমুদ্রা থেকে হামাগুড়ি হয়ে হাঁটা পর্যন্ত তার মা ভিন্ন কেউ খেয়াল করলো না । খেয়াল করলো দাঁত ওঠার সময় । উপরের মাড়ির সামনের দাঁত দুটো নিজেদের জাহির করার জন্য ঠোঁট ছাড়িয়ে যখন সিকি ইঞ্চি বেরিয়ে এলো তখন সহজেই নাম হল কোদালি । বহুদিন পর্যন্ত ওই নামেই সে বাকি সবকটা দাঁত বের করে উত্তরসূচক হেসেছে । কিন্তু সেই বহুদিনের বয়স আড়াই বছরের বেশি হয়নি । কোদলির দাঁতবিব্রতির সেই শুরু । সম্ভবত এই আলোচনায় পাঠক উনপঞ্চবিংশৎ সংখ্যাটা ভুলেছেন । গল্পটার এই সংখ্যায় স্থান হবার কারণ কোদালির বয়স এখন চব্বিশ । যদিও ষোলো বছর চার মাস সাতদিন পূর্ণ হবার পর আর কেউ তার বয়স জিজ্ঞাসা করেনি । কারণ ওই দিনই কোদালি মন্ডল , মাফ করবেন , মালতি মন্ডলের বিয়ে হয় বাঁদরভুলার পরান করালীর সাথে । পরান করালীর বাড়িতে সবই ছিল । সবও ছিল । সবের মধ্যে মালতির দুই শাশুড়ি , এক শ্বশুর , এক বড় বিধবা ননদ , এক বুড়ি পিসিশাশুড়ি । চমকাবেন না মালতির শ্বশুর ছিলেন দুটি বউয়ের মালিক । প্রথম পক্ষের গভভে একের পর এক মেয়ে জন্মাতে থাকায় একমাত্র ওই পিসির মাথাকোটা অনুরোধেই তিনি দ্বিতীয়দ্বার গমন করেন । দুঃখের বিষয় দ্বিতীয়দ্বার দিয়ে পুত্র সন্তান এসে করালী বংশের মুখ–পশ্চাৎ কোন অঙ্গই উদ্ধার করেনি । বরং প্রথম পক্ষের গর্ভ আলো করে পরান করালী মালতির পিসশাশুড়ি , শ্বশুর ও অনুল্লেখ্য কয়েক জনের দুশ্চিন্তা নিশ্চিন্ত করে । লাথির ঘায়ে মুখ ও অন্যান্য অঙ্গ হয় কালো হয় বাঁজা দ্বিতীয় পক্ষের । আশ্চর্য , সে পক্ষ বাড়িতেই রয়ে যায় । পুত্রগর্বী প্রথমের একজন দাসী একান্ত প্রয়োজন । আর খাবে কম এমন হলেই গৃহস্থের মঙ্গল । সব ছিল কথার অর্থ তাদের সাড়ে চৌদ্দ বিঘে জমি ছিল । বান ডাকানো বৃষ্টি হলেও যেখানে গোলাভরা ধান হতো না । মানে করালী বাড়িতে শঙ্করার ডাকের অভাব হয়নি । রান্নাঘর বাদে কোঠা বাড়ি ছিল । নগা মন্ডলের ষষ্ঠ উৎপত্তি মালতির এমন ঘরেবরে বিয়ে হওয়াটা রূপকথার দেশি সংস্করণ । আর বিয়ে যেহেতু দাঁত সমেতই হয়েছিল ।
ওই দাঁতের জন্য মুখ কোন দিন পুরো বন্ধ হতো না । যার ফলে ফুলশয্যা থেকেই পরানের অতৃপ্তি আসে । ভালো করে চুমোও খেতে পারতো না কোদালি । জোর করতে গেলে উদ্দিষ্ট অঙ্গে দাঁতের খোঁচা বা ঠোকা যাই বলুন , জোর বাজত । তখনও পণের বিশহাজার টাকা আর পাঁচ ভরি গয়না কচকচ করছিল বলে বাজে চুমো নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো হয়ে ওঠেনি পরানপক্ষের । পরান প্রতি রাত্রে নটার ঘায়ে বাড়ি ঢুকেছে । সাড়ে আটটায় চোলাই ঠেক দোর দিলে পরানের একা একা বড় ভয় করত । তাই সে অন্ধকার দোলাতে দোলাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরেছে । মালতি ভাত বেড়ে গুছিয়ে দিলে বড় টেমিটা হাত চারেক তফাত রেখে করালী ভাত সাবড়াতো আর লালচে চোখে ইশারা হেসে মালতীকে নজর করতো । মালতি যারই মেয়ে হোক তারও লজ্জা ছিল । সে টুকরো হেসে চোখ নামিয়ে রাতের গুরগুরে প্রতীক্ষায় মেতে উঠতো । দাঁত বাদে আর বাধা দেবার কেউ তো ছিলও না ।
বছর দুয়েক এইভাবে চললে প্রজননবিদরা অস্থির হয়ে হুলবাক্যের আশ্রয় নেন । বলা দরকার হুলগুলি অত্যন্ত মোলায়েম ছিল । যেমন পাঁচুর মার মুখেভাতের হুল , বড়মার গড়নের হুল । ক্ষয়াটে চেহারার মালতি যে পেটে বাচ্চা ধরতে পারছে না তাতো নিশ্চিত । পিসশাশুড়ি নিরামিষ উনুনের ধার থেকে চেঁচিয়ে উত্তর করেছিলেন ‘সেই কথাই বলি বড়বউ । থানে আর দুটো ঢিল বেশি বাঁধলেই পারতিস ।‘ আর মালতিকে ডেকে খুব নিচে গলায় সবাইকে শুনিয়ে বলেছিলেন ‘পরানকে ঠিক মত আদর যত্ন করিস তো বউ ?? দেখিস ফসকে না যায় !!’ মালতির বুকের ভেতরটা তাল গাছের ওপরকার আকাশের মত খালি হয়ে গিয়েছিল । সেই দিন মালতি , ঋতুমতী রজস্বলা মালতি , পরানকে আদরের চোটে অস্থির করে তুলেছিল । পরদিন চাদর থেকে লাল দাগ তুলতে তার প্রাণান্ত হলেও জোৎস্নার আলোয় মালতির তুমুল বর্ষার কোন স্মৃতি চাদরের কোথাও ছিল না । আসবরসিক পরানের পক্ষে কাঁদবার অঙ্ক পর্যন্ত জেগে নাটক দেখা সম্ভব হয়নি ।
মালতি গর্ভবতী হলো তার আঠেরো বছরে । ছয় বছর আগের এক শ্রাবণ মাসের দুপুরে খবরটা শুনে করালীবাড়িতে আয়োজনের ত্রুটি ছিল না । উৎসাহের চোটে মালতির শ্বশুর তার সেই ছোট বউকে একবার লক্ষ্যও করে ফেলেছিলেন । আর পরান ঠেক থেকে ফেরার পথে কুন্ডুবাড়ির সামনের কাঁচা নর্দমার পাঁকে ঘুমিয়ে পড়েছিল । চৈত্র মাসের ধরা সময়ের অনেক আগেই করালীবাড়ি নিঝুম করে মালতির গর্ভস্রাব হয়ে যায় । পরান সেদিন কুন্ডুবাড়ি পর্যন্ত আসতে পারেনি । মালতির শ্বশুর দুপুরে না ঘুমিয়ে হুঁকো হাতে ঠায় দাওয়া অধিকার করেছিলেন । পরানের মা চেঁচিয়েছিলেন ‘ওই পেটে কি ছিলা থাকে ?? ঝাঁটার কাঠি … মরখুটে…’ একটু গলা নামিয়ে ‘যে নজর দিয়েছে তার সর্বনাশ হবে । আটকুঁড়ো হবি । মর মর ।‘
ইত্যাকার প্রবাহের বছরের ডেরেকের মাথায় মালতি পুনঃচেষ্টার ফলে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় , এবং ধীরে ধীরে কোদালিতে রূপান্তরিত হতে শুরু করে । উল্লেখযোগ্যভাবে অনুল্লসিত পরান ও পরিবারবর্গ মালতিকে যা দন্তবিদারন শুরু করে মালতির নিজের প্রকাশিত দাঁতগুলি শিউরে ওঠে । তিন মাস অপারগ বাপের বাড়িতে কোনরকমে মুখ গুঁজে মালতিকে শ্বশুরবাড়ির চুলোয় মুখ খুঁজতে হল । একা দুবেলা রাবণের পরিবারের অন্ন–ব্যঞ্জন–পান–তামাক জুগিয়ে যাবার ফাঁকে তার সৎশাশুড়ির হাত নুড়কুড় ছাড়া কিচ্ছু সে পায়নি । বুকের দুধ শেষ হলে স্নেহ শেষ হলো না । করালীবাড়ির একমাত্র ছেলের একমাত্র মেয়ের আদর মায়ের চোখের চৌকাট বেরোতে পারেনি কখনো । তার মধ্যেই কচি মেয়েটার সামান্য স্নেহ যে পরানের তরফের জুটেছিল তা সত্য । কিন্তু বরাদ্দ সময়টা রাত আটটার পর , কারণ তখনই পরান মদ্যপ্রসন্নে পিতা হত । খানিক বুকে জড়িয়ে শিশুটিকে আদর করে পরান ঘোর কান্না জুড়তো
“তুই ছিলা হলি নাই কেনে রে !!! একটা বিটার আমার দিগের কত দরকার !!!”
পরিবারের মুখপাত্র পরান করালীর আবেগ নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন বাড়ির সবাইকে কাঁদিয়ে দিতে । ভীষণ রুষ্টও করে তুলত মালতির প্রতি । বলাবাহুল্য তার কোদলিরূপের ইত্যবসরে পুনঃপ্রাপ্তি ঘটেছে । জীবনের দ্বিতীয় মাঘের জাড়ে বুকে সর্দি বসে পরান–মালতির মেয়েসন্তানটি অজ্ঞাতগমন করে । নিয়মিত বিলাপের বাঁধাধরা ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁপ ছাড়ে করালীরা ।
চব্বিশ বছরের বিফল বাঁচা ও আরও দুটি গর্ভস্রাবান্তে মালতি করালী এক মাথা চুল , উঁচু নাক , ও মাজা বর্ণবান একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলে পাড়ার নেড়িকে বকলশবাঁধা পোষ্য করার চেষ্টার মত মালতির কোদলিত্ব সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যায় । পরানের মা পুত্রবধূ-নাতিকে বেয়ান বাড়িতে পাঠাতে সর্বার্থে নারাজ হলে মালতি শ্বশুরবাড়িতেই অধিষ্ঠিত হয় । দক্ষিণের সবচেয়ে বড় ঘরটা শ্বশুরমশাই উপঢৌকন দেন । নাতিকে মুখদেখাই দেন সোনার নিমফলের গোট । এতে পরানের মা পর্যন্ত আশ্চর্যান্বিত । সংসারের প্রত্যেকটি কাজ থেকে পূর্ণরূপে বিশ্রাম পায় কোদালি , থুড়ি সে মালতি করালী , করালীবাড়ির একমাত্র পুত্রের একমাত্র পুত্রের জননী । আঁতুড়ের পর্ব মিটলে বাড়িতে একটি নতুন দুগ্ধবতী গাভীর উদয় হয় । পরান হাট থেকে নগদ আটচল্লিশ টাকায় নিয়ে আসে খোকার দুধ খাবার তাগিদে । তবে খোকা যদ্দিন মায়ের দুধ খাচ্ছে , তদ্দিন ওই দুধ মালতির প্রাপ্য বলে প্রত্যেকেই স্পষ্ট রায় দেন । পিসশাশুড়ি বিহ্বল হয়ে ছেলেকে দেখেন আর আবোল তাবোল বকেন
‘এমন রং !! এমন রূপ !! আহা বেঁচে থাকো সোনার চাঁদ । ওলে ওলে…’
মালতির বাবা ও পরানের কয়েকজন দিদির মাজা রঙের উল্লেখ বারবার বাতাসে ভাসে । মালতির সৎশাশুড়ি গরুর খাবার থেকে ঘরের খাবার যুগিয়ে যুগিয়ে দিনদিন বায়ুলীন হয়ে পড়েন । মালতি দাঁতের জন্য প্রাণভরে সন্তানকে হামি খেতে না পারলেও অন্যান্য আদরে পুষিয়ে নেয় । ‘বৌমা , বৌমা‘ মধুর ডাকে গগন ও মালতির মস্তক দুইই বিঘূর্ণিত হতে থাকে । পরান রোজ সন্ধে সাতটায় বাড়ি ফেরে । ঠেকে দুপাত্তরের বেশি ছুঁয়েও দেখে না । ঠেক বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে যায় । প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় একটা একসের জামবাটি ভর্তি দুধ মালতীকে নিজে হাতে খাওয়ান শাশুড়ি । আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহেই বংশের প্রদীপের জন্য লালসালু মোড়া লেপ তৈরি করে ধুনুরি । সারাদিন তুলোধোনা ট্যাং ট্যাং আওয়াজে বাড়ি মুখরিত । ভগবতী শ্রী শ্রী মা দুর্গার আগমন হলে করালীর আড়াই মাসের সন্তান নতুন গরদ জড়িয়ে মাতৃদর্শনে যায় । পাশের বাড়ির গৌশকট দুয়ারে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ায় । ষোল থেকে চব্বিশ এই আট বছরে প্রথম বছর ছাড়া কোনো দিনই মালতি মায়ের মুখদর্শন করতে পারেনি । সে মাতৃবন্দনা করলে বয়স্ক নারী ও পুরুষদিগের ধর্মাচরণের ব্যবস্থায় হানি ঘটত । এবছর সে পুত্রবতী । একটি নধর , সাদা , টিকালো নাক ও আলুলায়িত কুন্তলবর্তী পুত্র তার । সে উচ্চকিতভাবে স্নেহাস্পদ ও সম্মানিত । কোদালি উর্ফ মালতির বর্তমান নজরটান তার দাঁত নয় তার ছিলা । শ্বশুর শাশুড়িকে দিয়ে মিষ্টিমিঠাই মালতিকে খাওয়াতে চেষ্টা করেন । শ্বশুর , শাশুড়ি আর পরান যেন ঘোড়দৌড়ের বাজি মারবার তালে আছে । এমনকি বাড়িতে ইলেকটিরি আলো নেবার তোড়জোড় শুরু হয় । কলকাতা থেকে আগেই দুটো পাখা চলে এসে আংটা গলায় বেঁধে ঝুলতে থাকে । একটা মালতির ঘরেও । গর্মিতে ছেলেকে সারারাত হাতপাখা টানতে নাকি মালতির বড়ই কষ্ট হচ্ছে । আশ্চর্য , রাতে মালতির হাতপাখা থেমে গেলে কতবার মাতালের লাথিতে তাকে মেঝেসই করে দিয়েছে পরান তাও এখন সবার বিস্মরণ । এ আদর অসহ্য ।
জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রে মালতি করালী তাহার তিন মাস সতেরো দিন বয়সী মাজা রঙের পুত্রসন্তানকে প্রগাঢ় চুম্বনান্তে কুয়ায় বিসর্জন দিল ।